[ম্যাক নিউজ ডেক্স]
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে একটি সংস্কারাধীন চার তলা ভবন। আনুমানিক ২২ ফুট দূরত্বে আছে একটি নিরাপত্তা দেয়াল, যার উচ্চতা ১৮ ফুট। ওই চার তলা ভবনের ওপর থেকে লাফিয়ে নিরাপত্তা দেয়াল পার হয়ে, এরপর আবার প্রায় ছয় ফুট উঁচু সীমানা দেয়াল টপকে রাস্তায় পৌঁছান কয়েদি ফরহাদ হোসেন রুবেল।
কারাগার তার পালিয়ে যাওয়ার এই তথ্য পুলিশের কাছেও অবিশ্বাস্য ঠেকছে। কিন্তু ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজে লাফ দেওয়ার দৃশ্য সংরক্ষিত আছে বলে দাবি পুলিশের।
কিন্তু লাফিয়ে প্রায় ৬০ ফুট অতিক্রমের মতো এই মৃত্যুঝুঁকি কেন নিল রুবেল? এই প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ দিয়েছে আরও চমকপ্রদ তথ্য। হত্যা মামলার আসামি রুবেলের ধারণা, বিচারে অবশ্যই তার মৃত্যুদণ্ড হবে। মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচতেই রুবেল মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়ে কারাগার থেকে পালিয়ে যান।
ফরহাদ হোসেন রুবেল কারাগারের কর্ণফুলী ভবনের পঞ্চম তলার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে থাকতেন। গত শনিবার (৬ মার্চ) ভোর থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এ ঘটনায় জেলার রফিকুল ইসলামের দায়ের করা মামলায় রুবেলকে গ্রেফতার অভিযানে নামে কোতোয়ালি থানা পুলিশের পাঁচটি টিম। মঙ্গলবার (৯ মার্চ) সকাল ৯টার দিকে তাকে নরসিংদী জেলার আদিয়াবাদ শেরপুর কান্দাপাড়া চরাঞ্চলে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে পুলিশ। সন্ধ্যায় রুবেলকে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে আসা হয়।
নগর পুলিশের দক্ষিণ জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) পলাশ কান্তি নাথ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সদরঘাট থানার একটি হত্যা মামলায় রুবেলকে আমরাই গত ৮ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করেছিলাম। সে পালিয়ে যাওয়ার পর কোতোয়ালি থানায় যখন মামলা হলো, সিএমপি কমিশনার স্যারের নির্দেশে আমরা পাঁচটি টিম গঠন করে অভিযানে নামি। নরসিংদীতে ফুপুর বাড়ি থেকে আমরা তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হই।’
সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও রুবেলের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এডিসি পলাশ কান্তি নাথ জানান, শনিবার ভোরে নিয়মিত কার্যক্রম অনুযায়ী কারাগারে ওয়ার্ড ও সেলের তালা খোলা হয়। এর কিছুক্ষণ পর বন্দি গণনার কাজ শুরু হলে কর্ণফুলী ভবনের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে রুবেলকে অনুপস্থিত দেখা যায়। কারারক্ষী নাজিম জানান, রুবেল ভোর সোয়া ৫টায় ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে দেখা যায়, রুবেল ওই ভবনের নিচে নেমে ট্যাংক থেকে পানি নিয়ে চোখেমুখে ঝাপটা দেয়।
‘এরপর প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ গজ দূরত্বে ৩২ নম্বর সেল হিসেবে ব্যবহৃত চার তলা ভবনের ছাদে ওঠে। সেলটিতে কোনো বন্দি ছিল না। সেটা আগে দোতলা ছিল। এখন চার তলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজ চলছে। ফুটেজে দেখা গেছে, ভবনটির গেট বন্ধ থাকায় রুবেল জানালা বেয়ে দোতলা পর্যন্ত উঠে এরপর সিঁড়ি দিয়ে চার তলার ছাদে ওঠে। এই ভবন থেকে ২২ ফুট দূরে নিরাপত্তা দেয়াল, যেটি ১৮ ফুট উঁচু। চার তলা ভবনের ছাদ থেকেই লাফ দিয়ে রুবেল নিরাপত্তা দেয়াল পার হয়। এরপর আছে প্রায় ৬ ফুট সীমানা দেয়াল। সেখানে কাঁটাতারের বেড়াও আছে। হয়তো দেওয়াল টপকে অথবা কাঁটাতারের বেড়া গলে রুবেল বেরিয়ে যায় আনসার ক্লাবের সামনে দিয়ে পাথরঘাটা যাওয়ার সড়কটিতে,’— বলেন এডিসি পলাশ কান্তি নাথ
তিনি আরও বলেন, ‘যদি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আমরা তার লাফ দেওয়ার দৃশ্য না দেখতাম, তাহলে আমাদেরও বিশ্বাস হতো না। আমরা বিষয়টি দেখেছি বলেই বিশ্বাস করেছি। রুবেল মাদকাসক্ত ছিল। নিয়মিত ইয়াবা-গাঁজা সেবন করত। মাদকাসক্ত মানুষের কর্মকাণ্ড যেমন হয়, তেমনই হয়েছে বলে আমাদের ধারণা।’
হাজতি রুবেলের বাম পায়ে ব্যান্ডেজ, চোখ-মুখ ফোলা এবং মুখে ও হাতে-পায়ে জখমের চিহ্ন দেখা গেছে। নগর পুলিশের কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) নোবেল চাকমা সারাবাংলাকে জানান, লাফিয়ে পড়ার পর তার বাম পা মচকে গেছে। সেই পা নিয়েই সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশায় করে রুবেল চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে যান। অটোরিকশাচালককে তিনি বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। চালক স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে তার কাছ থেকে ভাড়াও নেননি। শনিবার সকাল ১০টা নাগাদ রুবেল ট্রেনযোগে ঢাকা হয়ে নরসিংদী যান।
এসি নোবেল চাকমা বলেন, ‘আমাদের ধারণা, লফিয়ে পড়ার সময় তার নিজের মধ্যে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। অনেকে শরীরে আঘাত পাওয়ার পরও কিছুক্ষণ সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মতো হাঁটাচলা করতে পারে। পরবর্তী সময়ে তার শরীরে প্রতিক্রিয়াগুলো দৃশ্যমান হয়। শরীরে প্রতিক্রিয়া শুরুর আগেই রুবেল স্টেশনে পৌঁছেছে। তবে এসব বিষয় তাকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদে নিশ্চিত হওয়া যাবে। একটা মানুষ লাফ দিয়ে ৬০ ফুট নিচে পড়েছে। স্বাভাবিকভাবে সে অসুস্থ। কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। সুস্থ হলে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করব।’
এই মৃত্যুঝুঁকি রুবেল কেন নিয়েছেন— জানতে চাইলে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘যে হত্যা মামলায় রুবেলকে সদরঘাট থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছে, মার্ডারটা কিন্তু সে করেছে। সে জানে, যেহেতু খুন সে করেছে তার ফাঁসি হবেই। তার বিরুদ্ধে আরও পাঁচটা মামলা আছে। আগেও সে জেল খেটেছে। এসব বিষয় তার ভালোই জানা আছে। সুতরাং তার মধ্যে একটা ফাঁসির ভয় ঢুকে যায়। রুবেল আমাদের জানিয়েছে, সে ভেবেছিল— কারাগার থেকে পালিয়ে গিয়ে সে থাকতে পারবে। চট্টগ্রাম ছেড়ে গেলে পুলিশ তাকে আর ধরতে পারবে না। সে ফাঁসি এড়াতে পারবে। মূলত এটা ভেবেই সে এতবড় রিস্ক নেয়।’
মাত্র চার দিনের মধ্যে রুবেলের সন্ধান পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি নেজাম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা সম্পূর্ণ গোয়েন্দা তথ্যের ওপর নির্ভর করেছি এবং সাফল্য পেয়েছি। পালিয়ে চট্টগ্রাম শহরে কোথায় যেতে পারে, এই শহরে তার কোনো আত্মীয়স্বজন আছে কি না, অতীতে যখন জেলে গেছে জামিনে বেরিয়ে কার কাছে গিয়েছিল, সর্বশেষ কোন আত্মীয়ের বাসায় রুবেল গিয়েছিল— এসব বিষয় আমরা যাচাই-বাছাই করেছি। এক্ষেত্রে কেবল তথ্যপ্রযুক্তির ওপর আমরা নির্ভর করিনি, আমাদের পাঁচটি টিম কাজ করেছে।’
গ্রেফতার রুবেলকে জেল থেকে পালানোর মামলায় সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজিরের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওসি নেজাম উদ্দিন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আইয়ূব উদ্দিন সারাবাংলাকে জানান, শনিবার কারাগার থেকে পালিয়ে নরসিংদীতে প্রথমে রুবেল তার নিজের বাড়ি মীরকান্দিতে যান। সেখান থেকে ওই দিনই আবার ফুপুর বাড়ি আদিয়াবাদে চলে যান। সেখানে একটি চরের মধ্যে ঝোঁপঝাড়ের ভেতরে লুকিয়ে ছিলেন। তার ধারণা, চরে লুকিয়ে থাকলে পুলিশ তাকে খুঁজে পাবে না। ফুপুর বাড়ির পাশে ওই চরে তিন রাত ছিল রুবেল।
‘হৃদয় নাম দিয়ে নরসিংদীর সরকারি হাসপাতালে ভর্তির পরিকল্পনা করেছিল রুবেল। গ্রামের বাড়িতে তার একটি চোরাই মোটরসাইকেল ছিল। একজন নিকটাত্মীয় মোটরসাইকেলটি চালাতেন। সেটি বিক্রির জন্য ফুপাত ভাইয়ের মাধ্যমে চেষ্টা করছিলেন। মোটরসাইকেল বিক্রির টাকা দিয়ে হৃদয় নামে হাসপাতালে ভর্তির পরিকল্পনা করেছিলেন রুবেল। কিন্তু এর আগেই আমরা তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হই,’— বলেন এসআই আইয়ূব।
মো. ফরহাদ হোসেন রুবেল নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার মীরেরকান্দি গ্রামের শুক্কুর আলী ভাণ্ডারির ছেলে। রুবেল নগরীর সদরঘাট থানায় দায়ের হওয়া একটি হত্যা মামলার আসামি। গত ৮ ফেব্রুয়ারি আগ্রাবাদের মিস্ত্রিপাড়া থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি কারাগারে ছিলেন।
হাজতী নিখোঁজের ঘটনার পর কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার ও ডেপুটি জেলারকে প্রত্যাহার করা হয়। দুই কারারক্ষীকে বরখাস্ত ও এক কারারক্ষীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। এছাড়া কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন পৃথক দু’টি তদন্ত কমিটি করেছে।