[ম্যাক নিউজ ডেস্ক]
দৃষ্টিশক্তির পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক রোগগুলো নানা কারণে হতে পারে। এক এক করে দেখে নেওয়া যাক সেই রোগগুলোর ধরনধারণ।
ডায়াবিটিসের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে শরীরের অনেক অঙ্গ এবং সিস্টেমের ক্ষতি হয়। চোখের রেটিনার মাধ্যমে ভিসুয়াল ইনফর্মেশন অপটিক নার্ভে গিয়ে পৌঁছয়। রক্তে সুগার বাড়লে রেটিনার সরু রক্তবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সরু রক্তজালক চিরে যায়। সেখান থেকে রক্ত এবং অন্যান্য তরল লিক করে। ফলে রেটিনার টিসু ফুলে ওঠে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। ডায়াবিটিসের অন্যতম ক্ষতিকর দিক হল রেটিনোপ্যাথি, যা থেকে অন্ধত্ব আসতে পারে। এই ক্ষতি শুরু হয় খুব সূক্ষ্ম ভাবে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ বেড়ে চলে। দীর্ঘ দিন ডায়াবিটিসে ভুগলে এই রোগের আশঙ্কা বাড়ে। ক্ষতি যত তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে, চিকিৎসা শুরু হবে, দৃষ্টিশক্তি হারানোর আশঙ্কা তত কম।
এ রোগ প্রতিরোধের উপায় হল, ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে রেটিনোপ্যাথি বাধাতে না পারে। সেই কারণে—
• নিয়ম করে ডায়াবিটিসের ওষুধপত্র খেতে ও ইনসুলিন নিতে হবে।
• স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া করতে হবে। রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়, এমন খাবার বাদ দিয়ে দিতে হবে একেবারে।
• রোজ ক্ষমতা অনুযায়ী শারীরচর্চার অভ্যেস গড়ে তুলতে হবে।
• নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের মাত্রাও।
• মদ্যপান এবং ধূমপান ছাড়তে হবে।
খাদ্যতালিকায় যেন যথেষ্ট পরিমাণে টাটকা ফলমূল এবং আনাজপাতি থাকে। খাওয়াদাওয়ার উপরে চোখের স্বাস্থ্য গভীর ভাবে নির্ভরশীল। সেপ্টেম্বর ২০১৯-এর ঘটনা। ব্রিটেনে এক কিশোরের আকস্মিক অন্ধত্ব দেখা দেয়। গবেষণায় জানা যায়, ছেলেটি দীর্ঘ কয়েক বছর পটেটো চিপ্স, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং প্রসেসড পর্ক প্রডাক্ট ছাড়া কিছুই খায়নি। এই ধরনের ঘটনা অপটিক নিউরোপ্যাথির একটি চূড়ান্ত উদাহরণ। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস চোখের সুস্থতার জন্যও অপরিহার্য।
এই রোগের চিকিৎসায় চোখে সরাসরি ইঞ্জেকশন দিয়ে রক্তজালিকার ক্ষতি আটকানো যায়, প্রদাহও থামানো যায়। রক্তজালিকার কোনও অংশ চিরে গেলে, লেসার থেরাপির সাহায্যে তা মেরামত করা সম্ভব। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির খুব অ্যাডভান্সড পর্যায়ে সার্জারি আবশ্যক হয়ে পড়ে। সার্জারির মাধ্যমে চোখের পিছন থেকে ভিট্রিয়াস হিউমরকে প্রতিস্থাপন এবং ডিটাচ হয়ে যাওয়া রেটিনাকে পুনর্স্থাপন করা হয়।
গ্লকোমা
রোগীর অজান্তেই তার দৃষ্টির বিস্তৃতি পরিধি থেকে ক্ষয় পেতে পেতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে। রোগী হয়তো অনেক দূর অবধি স্পষ্ট দেখছেন, কিন্তু সেটা একটা গোলাকার নলের মধ্য দিয়ে দেখার মতো। আশপাশের জিনিস দেখতে পাওয়া যায় না। গাড়ি চালাতে অসুবিধে হয়। লক্ষণ টের পাওয়া যায় না, তাই ধরা পড়তেও দেরি হয়ে যায় অনেকটাই।
রোগের কারণ, অপটিক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। ক্ষতি হওয়ার কারণ চোখের ভিতরকার ইন্ট্রাঅকিউলার প্রেশার। অক্ষিগোলকের ভিতরে যে তরল থাকে, তার নাম অ্যাকুয়াস হিউমর। এর চাপ নির্দিষ্ট মাত্রা পেরোলে অপটিক নার্ভে চাপ পড়ে দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি হয়।
বিশিষ্ট চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডা. সুমিত চৌধুরী বললেন, “যখন রোগী টের পান, তখন ক্ষতি অনেকখানি হয়ে গিয়েছে। দৃষ্টিশক্তি কমে যায়, রোগী চোখে ঝাপসা দেখেন, তখন বুঝতে হবে কেন্দ্রীয় দৃষ্টিশক্তিরও ক্ষতি হতে শুরু করেছে। বিশেষ কোনও গ্লকোমার ক্ষেত্রে চোখের দৃষ্টি খুব ঝাপসা হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখে ব্যথা করা বা লাল হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা যায়। চশমার কাছের পাওয়ার খুব কম সময়ের ব্যবধানে বারবার বদলে যাওয়াও গ্লকোমার লক্ষণ হতে পারে। অনেক সময়ে দেখা গিয়েছে, যাঁদের চোখে বেশি মাইনাস পাওয়ার, টাইপ টু ডায়াবিটিস আছে, চোখে কোনও চোট বা আঘাত লাগার মতো ঘটনা রয়েছে, থাইরয়েড, মাইগ্রেন, পরিবারে কারও গ্লকোমা ধরা পড়েছে, দেহের ওজন খুব বেশি, বহু দিন ধরে স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ খেতে হলেও এই রোগের আশঙ্কা বেশি।”
রোগনির্ণয়ের পদ্ধতি সম্পর্কে ডা. চৌধুরী বললেন, “প্রথমে রোগীর চোখের প্রেশার বা আইওপি চেক করা হয়। আইওপি দেখার পর গোনিওস্কোপির মাধ্যমে চোখের ভিতরের কোণ বা অ্যাঙ্গল অফ অ্যান্টেরিয়র চেম্বার পরীক্ষা করা হয়। এর মাধ্যমে গ্লকোমাকে ওপেন অ্যাঙ্গল বা ক্লোজড অ্যাঙ্গল গ্লকোমাতে ভাগ করা হয়। ওপেন অ্যাঙ্গল হলে বুঝতে হবে চোখের ভিতরে অ্যাকুয়াস হিউমরের চাপ বেড়েছে, কিন্তু তরল বেরোনোর পথ খোলা আছে। ক্লোজ়ড অ্যাঙ্গলের ক্ষেত্রে এই পথটি বন্ধ হয়ে যায়। চোখে অনেক সময়ে ব্যথা হয়, লাল হয় ও ঘন ঘন চালশের ফলে চশমার পাওয়ার বদলাতে হয়।”
অ্যাঙ্গল দেখার পরে চোখের নার্ভের কতটা ক্ষতি হয়েছে, সেটা দেখা হয়। অটোমেটেড পেরিমেট্রিতে চোখের কতটা দৃষ্টিক্ষেত্র নষ্ট হয়েছে, তা ধরতে পারা যায়। কখনও পেরিমেট্রিতে ধরা না পড়লে বা নিশ্চয়তার জন্য ওসিটি বা অপটিকাল কোহেরেন্স টোনোগ্রাফি পরীক্ষা করা হয়। অনেক সময়ে কিন্তু আইওপি বা ইন্ট্রাঅকিউলার প্রেশার স্বাভাবিক বা কম থাকা সত্ত্বেও অপটিক নার্ভের ক্ষতি হতে পারে। এ সব ক্ষেত্রে অটোমেটেড পেরিমেট্রি বা ওসিটি না করলে রোগ শনাক্ত করা যায় না।
ডা. চৌধুরী বললেন, “রোগটি যত আগে ধরা পড়ে, তত দ্রুত ক্ষতি আটকানো সম্ভব। যতটুকু দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়েছে, তা আর ফেরত আসে না, কিন্তু অবশিষ্ট দৃষ্টিশক্তি সুরক্ষিত রাখা যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে চিকিৎসক কিন্তু শুধু প্রেসক্রিপশনই দেন, বাকিটা নির্ভর করছে রোগী ও তাঁর পরিবারের সতর্কতার উপরে। নিয়ম মেনে ওষুধ প্রয়োগ করে চলার সঙ্গে-সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে চোখ পরীক্ষা করিয়ে যেতে হবে। তবেই প্রতিরোধ করা সম্ভব গ্লকোমা জনিত দৃষ্টিহীনতা।”
ক্যাটারাক্ট বা ছানি
চোখের নিজস্ব স্বাভাবিক লেন্সের স্বচ্ছতা কমে আসাই ছানি। এতে লেন্সের উপরে প্রোটিন জমে গিয়ে ক্লাউডিং বা ঝাপসা ভাব তৈরি হয়। ফলে আলোকরশ্মি সরাসরি রেটিনায় গিয়ে পড়তে পারে না। এটা খুব সাধারণ এবং প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই হয়। বেশি বয়সে প্রায় সব মানুষেরই এমন রোগ হয়। অন্তত গড়ে ৬৫-৭০ বছর বয়সের পর একটি বা দু’টি চোখেই এই রোগ দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু অতি বিরল হলেও শিশুবয়সেও এই রোগ দেখা যেতে পারে। যেহেতু রোগটি খুবই স্বাভাবিক এবং সকলেরই হয়, সেই কারণে চিকিৎসা না করালে কিন্তু এটিকেই অন্ধত্বের সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে।
এই রোগের লক্ষণগুলো হল, দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ কমে আসা, ঠিক চশমা পরেও ভিশনের সমস্যা।