[ম্যাক নিউজ ডেস্ক]

সম্প্রতি তালেবান ইঙ্গিত দিয়েছে যে, তারা ১৯৬৪ সালের আফগান সংবিধানকে নতুন সংবিধানের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে চায়; যার খসড়া তৈরি করা হবে। এটিকে সাধারণভাবে ইতিবাচক ইঙ্গিত হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। কারণ ১৯৬৪ সালের সংবিধান অতীতে আফগানিস্তানের ‌‘গণতান্ত্রিক দশকের’ সূচনা হিসেবে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছিল। তবে এই সংবিধানে রাজনৈতিক দলের উল্লেখ নেই। সত্তর দশকের আফগান সংবিধান মূলত রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার কথা বলে। এখন আমাদের এটিও দেখতে হবে, তালেবানরা আসলে সংবিধানে কোন ধরনের সংস্কার আনতে চায়।

তালেবানরা তাদের পূর্ববর্তী সরকারের কর্মকর্তাদের নতুন সরকারে অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। যার রূপরেখা তারা গত কয়েক মাস ধরে ঠিক করেছে। তৎকালীন তালেবান সরকারের বিশিষ্টজনদের মধ্যে আছেন সাবেক আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালাহউদ্দিন রাব্বানি, সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এবং সাবেক ডেপুটি-প্রেসিডেন্ট করিম খলিলি।

কিছু ইসলামী দল এবং গোষ্ঠী যেমন— গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ারের নেতৃত্বাধীন হিযব-ই-ইসলামি তালেবানদের সাথে চুক্তি করেছে এবং আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ সরকারে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার সম্ভাবনা আছে। তালেবানরা মাঝারি পর্যায়ের টেকনোক্র্যাট এবং আমলাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি তাদের অনেকেই পরবর্তী সরকারে কাজ করার জন্য তালেবানের কাছ থেকে দেশে থাকার আমন্ত্রণ পেয়েছেন।

উন্নত সামরিক সরঞ্জাম পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে সেনা বিশেষজ্ঞদের খুঁজতে শুরু করেছে তালেবান। বিদ্রোহী এই গোষ্ঠীর সম্ভাব্য জোটের অংশীদারদের কেউই কখনোই নারীর অধিকারের বিষয়ে খুব বেশি সক্রিয় ছিলেন না। এমনকি প্রাথমিকভাবে তারা প্রায়ই নারীর অধিকারের বিষয়গুলো প্রতিরোধ করেছেন। যদিও তারা শেষ পর্যন্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রগতিশীল আইনের সাথে খুব বেশি ঝামেলা ছাড়াই সহাবস্থান নিশ্চিত করেছিলেন এবং এই আইনগুলো দেশটির বেশিরভাগ শহরের উপকেন্দ্রেই খুব সীমিত পরিসরে বাস্তবায়িত হয়েছে।

আফগানিস্তানের বিদ্যমান আইনগুলো বাতিল করা হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। একই সঙ্গে তালেবানরা কতটুকু পিছু ফিরে তাকাবে সেটিও পরিষ্কার নয়। এখন পর্যন্ত দখলকৃত নতুন এলাকাগুলোতে তালেবান একই নিয়ম-নীতি চালু করেছে; যা ২০০৩ সাল পর্যন্ত অনেক গ্রামীণ এলাকায় কার্যকর ছিল। সেই সময় শুধুমাত্র ১২ বছরের নিচের মেয়ে শিশুরা প্রাথমিক স্কুলে যাওয়ার অনুমতি পেতো। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো প্রয়োজনীয় সেবাখাতে নারীরা চাকরির সুযোগ পেতেন না, একা বাড়ি থেকে বের হতে পারতেন না এবং তাদের বুরকা পরা বাধ্যতামূলক ছিল। টেলিভিশন-গানবাজনা নিষিদ্ধ, নামাজের সময় মসজিদে উপস্থিতি বাধ্যতামূলকসহ আরও নানা ধরনের বিধি-বিধান জারি করেছিল তালেবান।

যদি এসব ছেড়ে তালেবানরা এগিয়ে যায়, তাহলে প্রাথমিকভাবে সেটিও হবে সীমিত পরিসরে। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের বিষয়টিও মোকাবিলা করতে হবে তাদের। তালেবানের ইসলামপন্থী ও সুফি মিত্ররা কিছুটা মধ্যপন্থী মনোভাব দেখাতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে বুরকার পুনঃপ্রবর্তনের পরিকল্পনা বাদ দিতে তালেবানকে রাজি করার চেষ্টা করতে পারেন এই মিত্ররা।

তবে সামগ্রিকভাবে ভবিষ্যতের তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকার নিয়ে যেসব প্রাথমিক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে তা বাস্তব রূপ পেতেও পারে। তালেবান সরকারকে প্রতিবেশী পাকিস্তান, ইরান, রাশিয়া, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং চীনের সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যেতে হবে। এসব দেশের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক এখনো বিদ্যমান থাকলেও তাদের ওপর পুরোপুরি আস্থা নেই। সবারই স্বার্থ আছে এবং তারা চায় সেই সম্পর্কে তালেবান শ্রদ্ধাশীল হোক।

অর্থনীতি এবং জরুরি পরিষেবার বিষয়গুলো সচল রাখতে গিয়ে তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকারকে কিছুটা বেগ পেতে হবে। তালেবানের দেশ দখলের অভিযান এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আফগানিস্তানের অনেক জায়গায় এসব সেবা স্থবির হয়ে পড়েছে। আফগানিস্তানের প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন নতুন জোটের স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভর করবে। বিভিন্ন ইসলামি দল, যারা প্রায়ই আঞ্চলিক এবং সাম্প্রদায়িক স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে; তারা দীর্ঘমেয়াদে অধিক রক্ষণশীল তালেবানদের সফলভাবে সহযোগিতা করতে পারবে কি না সেটি নিয়েও প্রশ্ন আছে।

যদি তাই হয়, তাহলে ইসলামপন্থীদের অধিক প্রযুক্তিগত আকাঙ্ক্ষা এবং আঞ্চলিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর সাথে তালেবানের ধর্মীয় নেতাদের সমন্বয় আরও বাড়াতে হবে। ইতোমধ্যে তালেবান ইঙ্গিত দিয়েছে যে, তারা ইরানের নীতি-নির্ধারণী অভিভাবক পরিষদের আদলে জ্যেষ্ঠ ইসলামিবিদদের নিয়ে একটি পরিষদ গঠন করবে। যে পরিষদ ধর্মীয় আইনের সাথে সামঞ্জস্যের ভিত্তিতে আইন এবং ডিক্রি জারি করবে। অন্যদিকে, তালেবানের অনেক মন্ত্রণালয় কলেজ-শিক্ষিত ইসলামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত হতে পারে।

বেশিরভাগ প্রতিবেশী দেশই আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা চায়; যে কারণে তালেবানের নতুন জোট সরকারে বাইরের নাটের গুরুরা কোনও ফাটল ধরাতে পারবে বলে মনে হয় না। একইভাবে ২০২১ সালের পরাজিতদের জন্য কোনও ধরনের প্রতিরোধ গড়ার অথবা তাদের সমর্থনে কাজ করতে পারে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়াও কঠিন হয়ে যাবে। যতদিন পর্যন্ত তালেবানের নতুন জোট সরকার প্রতিবেশী দেশগুলোকে প্রধান মিত্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করবে, অন্তত ততদিন আফগানিস্তানের ইতিহাসে এটি একটি নতুন পর্বের সূচনা হয়ে থাকবে তালেবানের এই যাত্রা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *