[ম্যাক নিউজ ডেস্ক]

নজরুল ইসলাম: সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জয়নুল আবেদীন ও তার ছেলে ফয়সাল আবেদীনের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিরুদ্ধে ৩৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। দুদক আইন, ২০০৪ এর ৩২ ধারা এবং দুদক বিধিমালা, ২০০৭ এর বিধি ১৫ এর উপবিধি (১) এর ক্ষমতাবলে কমিশন চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দিয়েছে। গত মঙ্গলবার এ অনুমোদন দেয়া হয়। যেকোনো দিন তা আদালতে দাখিল করা হবে।

জানা যায়, ২০১৯ সালের ২১ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ মামলাটি (নম্বর ৭) দায়ের করা হয়। দুদকের সহকারী পরিচালক হাফিজুর রহমান এটি দায়ের করেন। পরে উপপরিচালক শেখ গোলাম মাওলাকে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। তিনি সম্প্রতি কমিশনে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, সাবেক এ বিচারপতির স্ত্রী ও মেয়ের বিরুদ্ধে পৃথক দু’টি মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, বিচারপতি জয়নুল আবেদীন তার ছেলে ফয়সাল আবেদীনকে ফ্ল্যাট কেনার জন্য ২৬ লাখ টাকা দিয়েছেন। যাকে দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে ঘুষ-দুর্নীতির টাকা বলা হয়েছে। এর বাইরে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের ৯ লাখ ৪৯ হাজার টাকা সম্পদের বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে মোট ৩৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। 

অভিযোগপত্রের সারসংক্ষেপে বলা হয়, জয়নুল আবেদীনের মোট সম্পদ ১ কোটি ৩২ লাখ ৩৯ হাজার ১৭৪ টাকা। আয়ের উৎস পাওয়া গেছে ১ কোটি ৮৭ লাখ ৬৩ হাজার ৩০৪ টাকা। ১৯৮২-১৯৮৩ করবর্ষ থেকে ২০১০-২০১১ করবর্ষ পর্যন্ত তার পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয় ৬৪ লাখ ৭৪ হাজার ৩৯ টাকা। তার পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ অর্জিত সম্পদে ব্যয়িত টাকার পরিমাণ ১ কোটি ৯৭ লাখ ১৩ হাজার ২১৩ টাকা। পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ অর্জিত সম্পদে ব্যয়িত ১ কোটি ৯৭ লাখ ১৩ হাজার ২১৩ টাকার বিপরীতে আয়ের উৎস পাওয়া গেছে ১ কোটি ৮৭ লাখ ৬৩ হাজার ৩০৪ টাকা। আয়ের উৎসের তুলনায় অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ৯ লাখ ৪৯ হাজার ৯০৯ টাকা, যা তার জ্ঞাত আয়ের উৎসের তুলনায় অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ।

সম্পদ বিবরণীতে বিচারপতি তার ছেলেকে ২৬ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দিয়েছিলেন বলে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন। তার ছেলে ফয়সাল আবেদীনের আয়কর নথিতে এ তথ্য উল্লেখ রয়েছে। ক্রমান্বয়ে ঋণ পরিশোধের তথ্যও তার ছেলের আয়কর রিটার্নে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু, বিচারপতির আয়কর রিটার্নে ২৬ লাখ টাকা ব্যয় কিংবা ঋণদান এবং তা ফেরত প্রাপ্তির কোনো তথ্য নেই।

বিচারপতির দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে সংযুক্ত তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্ট পর্যালোচনা করে ওই সময়ে (২০০৫-২০০৬ এবং ২০০৬-২০০৭ কর বছর) তার অ্যাকউন্ট থেকে ২৬ লাখ

টাকা উত্তোলনের তথ্য পাওয়া যায়নি।

ফয়সাল আবেদীনের আয়কর নথিতে তার দায় ক্রমান্বয়ে পরিশোধ দেখানো হলেও বাবাকে ওই টাকা পরিশোধের কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এতে প্রতীয়মান হয়, সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীন তার অসাধুভাবে উপার্জিত অর্থ বৈধ করতে ২৬ লাখ টাকা তার ছেলে ফয়সাল আবেদীনের ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ করেছেন।

সাবেক এ বিচারপতি দুর্নীতি দমন কমিশনে তার স্ত্রীর নামে অর্জিত ৭ লাখ ৪৫ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ বিনিয়োগ ও ১ কোটি ৩২ লাখ ৩৯ হাজার ১৭৪ টাকার অস্থাবর সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিল করেন। তিনি অসাধু উপায়ে ৩৫ লাখ ৪৯ হাজার ৯০৯ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে তা নিজ ভোগদখলে রাখেন। ছেলে ফয়সাল আবেদীনকে ফ্ল্যাট কেনার জন্য ২৬ লাখ টাকা নিজ আয়কর নথি ও দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে না দেখিয়ে গোপন করে মিথ্যা তথ্যসংবলিত সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। যা দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৬(২) ও ২৭ (১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

ফয়সাল আবেদীন বাবা জয়নুল আবেদীনের ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অসাধু উপায়ে উপার্জিত ২৬ লাখ টাকার কথা জানতেন। তিনি অবৈধ আয়কে বৈধ করতে বাবার কাছ থেকে তা নেন এবং সম্পদ কেনেন ও দখলে রাখেন। তাই তিনি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৬(২) ও ২৭ (১) ধারার অপরাধে সহায়তা করে দণ্ডবিধি ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের নামে অনুসন্ধানের ফাইল খোলে দুদক। ১৮ জুলাই সম্পদের হিসাব চেয়ে বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে নোটিশ দেয় দুদক। নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১০ সালের ২৫ জুলাই তিনি হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন।

রিটের ওপর শুনানি নিয়ে সে সময় বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহাব মিঞা ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ বিষয়টি উত্থাপিত হয়নি বিবেচনায় খারিজ করে দেন। পরে ওই বছরের ২৫ অক্টোবর দুদক তাকে আরও একটি নোটিশ দেয়। প্রয়োজনীয় তথ্যসহ ৩ নভেম্বর তিনি ওই নোটিশের জবাব দেন।

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে সাবেক এ বিচারপতির বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। এ বিষয়ে দুদক তার ব্যাখ্যা চাইলে বিচারপতি জয়নুল ব্যাখ্যাও দেন। এরই মধ্যে অনুসন্ধানের কথা বলে সুপ্রিম কোর্টের কাছে সাবেক এই বিচারকের বিষয়ে কাগজপত্র চেয়ে একই বছরের ২ মার্চ চিঠি দেয় দুদক।

এর জবাবে ওই বছরের ২৮ এপ্রিল আপিল বিভাগের তখনকার অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুদকের কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ সমীচীন হবে না বলে সুপ্রিম কোর্ট মনে করেন। কোনো বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অসদাচরণ, দুর্নীতি বা অন্য কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়া তার প্রাথমিক তদন্ত বা অনুসন্ধান না করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয় সুপ্রিম কোর্টের ওই চিঠিতে।

সুপ্রিম কোর্টের এ ধরনের চিঠি নিয়ে সংসদ অধিবেশনে কড়া সমালোচনা হয়। পরে ২০১৭ সালের জুনে একটি দৈনিক পত্রিকায় এ বিচারপতির জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ও দুদকের অনুসন্ধান

উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান জয়নুল আবেদীন। আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে ২০০৯ সালে অবসরে যান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *