[ম্যাক নিউজ ডেস্ক]
নিজস্ব প্রতিবেদক: করতেন সরকারি চাকরি। গড়ে তোলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও। নিজেকে পরিচালক হিসেবে রেখে স্ত্রীকেই বানান সেই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। নিজের প্রভাব খাটিয়ে কাজও পাইয়ে দেন। প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘রক প্রপার্টিজ’। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ফেঁসে গেলেন দুর্নীতির মামলায়। বলছিলাম কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) সাবেক উপ-মহাব্যবস্থাপকের কথা। তাকে নিয়ে চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গতকাল রোববার ৯ কোটি ৯৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৭৭ টাকার দুর্নীতির অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এ উপপরিচালক জাহিদ কালাম মামলাটি দায়ের করেন। আসামিরা হলেনÑকেজিডিসিএলের সাবেক উপ-মহাব্যবস্থাপক ও রক প্রপার্টিজের পরিচালক আনিছ উদ্দিন আহমেদ, তার স্ত্রী ও রক প্রপার্টিজের চেয়ারম্যান কামরুন নাহার, রক প্রপার্টিজ ও মেটকো কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নেছার আহমদ এবং মেসার্স নুর সিন্ডিকেটের স্বত্বাধিকারী নুর মোহাম্মদ।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১১ সালের ২২ আগস্ট কেজিডিসিএলের তখনকার ব্যবস্থাপক (পুর-নির্মাণ) আসামি আনিছ উদ্দিন আহমেদ সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে ওই প্রতিষ্ঠানেরই নিবন্ধিত ঠিকাদার মেসার্স মেটকো কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী নেছার আহমদ ও তার স্ত্রী নুসরাত জাহান এবং আনিছ আহমেদের স্ত্রী কামরুন নাহারকে নিয়ে ‘রক প্রপার্টিজ’ নামে একটি ডেভেলপার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
পরে মেসার্স নুর সিন্ডিকেটের সঙ্গে একটি দরপত্র পরিচালনা ও নির্মাণকাজের চুক্তি করেন। চুক্তিতে বলা হয়, চট্টগ্রামের চাঁদগাওয়ে অফিসার্স আবাসিক এলাকার একটি ১০তলা ভবনের দরপত্রে অংশগ্রহণ ও নির্মাণকাজে সব ধরনের কাজের বিল বাবদ প্রাপ্ত টাকা থেকে মেসার্স নুর সিন্ডিকেট ১ দশমিক ৫ শতাংশ সুনামি (কমিশন) নেবে।
এজাহারে আরও বলা হয়েছে, কেজিডিসিএলের চট্টগ্রাম চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার কেজিডিসিএল অফিসার্স কোয়ার্টারে ১০তলা সি-টাইপ ভবন নির্মাণে দরপত্র কার্যক্রম পরিচালনা করেন আনিছ উদ্দিন আহমেদ। দরপত্রে তিনিই কর্ণফুলীর পক্ষে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। ঠিকাদারের কাছ থেকে কাজ বুঝে নিয়ে নিজেই বিলের প্রত্যয়ন ও অনুমোদন করেন। বিল অনুমোদনের পর ঠিকাদার বিল উত্তোলন করে তার ব্যাংক হিসাবে জমা করেন। ঠিকাদার নিজের কমিশন রেখে বিলের বাকি টাকা আনিছ উদ্দিন আহমেদের মালিকানাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান ‘রক প্রপার্টিজ’-এর ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করেন।
এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে নিজে লাভবান হতে অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তারা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন, ২০০৬-এর ৬৪(৩) ও ৬৩(৪) ধারা লঙ্ঘন করেছেন। মেসার্স নুর সিন্ডিকেট নামের প্রতিষ্ঠানের ছদ্মাবরণে ‘রক প্রপার্টিজ’কে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন। তারা নির্মাণকাজের পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫৩ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ক্রয়কারী ও ঠিকাদার নিজেদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে যৌথ ও একক হিসাব খুলে তাতে টাকা রেখেছেন। ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২’-এর সম্পৃক্ত অপরাধ ‘দুর্নীতি ও ঘুষ’-এর মাধ্যমে অপরাধলব্ধ অর্থ হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তর করে মোট ৯ কোটি ৯৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৭৭ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অপরাধ করেছেন।
গত ২ ফেব্রুয়ারি মামলাটি দায়েরের অনুমোদন দেয় দুদক কমিশন। দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২) ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, তদন্তকালে ঘটনার সঙ্গে অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাও আমলে নেয়া হবে। ২০১১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা ব্যাংকের চট্টগ্রামের সিডিএ এভিনিউ শাখায় আসামি আনিছ উদ্দিন আহমেদ, তার স্ত্রী কামরুন নাহার ও নেছার আহমদ মিলে ‘রক প্রপার্টিজ’-এর নামে চলতি হিসাব খোলেন। সেখানে তারা নিজেদের শেয়ারহোল্ডার হিসেবে পরিচয় দেন। তিনজনের স্বাক্ষরে হিসাবটি পরিচালনা হবে বলে তারা ঘোষণা করেন। ২০১৫ সালের ৭ অক্টোবর ওই ব্যাংক হিসাবে চার কোটি ৯৫ লাখ ৭৮ হাজার ৭১৫ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করা হয়।
২০১৮ সালের ৯ ডিসেম্বর কামরুন নাহার ও নেছার আহমদ ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দেয়ার জন্য ব্যাংকের ওই শাখা ব্যবস্থাপককে অনুরোধ করেন। এদিকে আসামি কামরুন নাহারের ব্যক্তিগত ছয়টি ব্যাংক হিসাবে মোট এক কোটি ৭৫ লাখ ৮৪ হাজার ৯৪৪ টাকা রয়েছে, যা ফ্রিজ করার প্রক্রিয়া চলছে।
এছাড়া আসামি আনিছ উদ্দিন আহমেদ ও নেছার আহমদ যৌথ নামে ঢাকা ব্যাংকের চট্টগ্রামের সিডিএ এভিনিউ শাখায় একটি স্থায়ী আমানত হিসাব খোলেন। সেটিতে তিনি ১৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা জমা ও পরে উত্তোলন করেন। মেসার্স নুর সিন্ডিকেটের অথরাইজড সিগনেটরি ও মেসার্স রক প্রপার্টিজের এমডি নেছার আহমদের কাছ থেকে এ টাকা আনিছ উদ্দিন আহমেদ ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন। পরে তা যৌথ ব্যাংক হিসাবে জমা ও উত্তোলন করেছেন।
তদন্তকালে সংগৃহীত রেকর্ডপত্র অনুসারে ঢাকা ব্যাংক চট্টগ্রামের সিডিএ এভিনিউ শাখায় রক প্রপার্টিজের ব্যাংক হিসাবে চার কোটি ৯৫ লাখ ৭৮ হাজার ৭১৫ টাকা, আনিছ উদ্দিন আহমেদ ও নেছার আহমদের যৌথ ব্যাংক হিসাবে ১৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা এবং আনিছ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী কামরুন নাহারের নামে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে চার কোটি ৭৮ লাখ তিন হাজার ১৬২ টাকাসহ মোট ৯ কোটি ৯৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৭৭ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন।