[ ম্যাক নিউজ ডেস্ক ]
বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা টেস্ট নেগেটিভ ফল প্রাপ্তির আশ্বাস দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্র। এই চক্রের ১৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে আত্মসাৎকৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ ও প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত মালামাল জব্দ করা হয়।
বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বুধবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে গোপন সংবাদে প্রথমে কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় জসিম উদ্দিন, সুলতান মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও ঢাকার সায়েদাবাদ, রমনা ও মতিঝিল এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বেলাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বেলালের দেওয়া তথ্যে মতিঝিল এলাকা থেকে চক্রের সক্রিয় সদস্য আবুল হোসেন মো. আবদুল নুর, আলফাজ মিয়া, শামিম ও আহাম্মদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, তাদের দেওয়া তথ্যে মোবাইল সিমের যোগানদাতা ইমরান উদ্দিন মিলনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় অভিযান পরিচালনা করে চক্রের অন্যতম হোতা সবুজ মিয়া, আব্দুর রশিদ, আব্দুল করিম চৌধুরী (১৩), আঙ্গুর মিয়া এবং মো. আলমগীর হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। জব্দ করা হয় প্রায় ৭ লাখ টাকা।
কমান্ডার মঈন বলেন, প্রতারক চক্রের মূলহোতা গ্রেপ্তারকৃত বেলাল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, গত বছরের মার্চ মাসে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার জন্য কুমিল্লা জেলার একটি হাসপাতালে করোনা টেস্ট করার পর অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ওই হাসপাতালের ডাক্তার পরিচয় দিয়ে তার করোনা টেস্টের ফল পজিটিভ এসেছে বলে জানায়। অজ্ঞাত ব্যক্তি দশ হাজার টাকার বিনিময়ে বেলালের করোনা টেস্টের ফল নেগেটিভ করার প্রতিশ্রুতি দিলে, সে চড়া মূল্যের টিকেট নষ্ট না করে ওই ব্যক্তিকে বিশ্বাস করে দশ হাজার টাকা দেয়। পরবর্তীতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মোবাইলে এসএমএস এর মাধ্যমে করোনা পজিটিভ ফল প্রেরণ করে। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলে ওই অজ্ঞাত পরিচয়ধারী কেউ হাসপাতালে কর্মরত নেই বলে জানতে পারে। পুনরায় এপ্রিল মাসে করোনা টেস্ট নেগেটিভ আসার পর বেলাল ওমানের উদ্দেশ্যে গমন করে। তবে মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বেলাল প্রতারণার প্রক্রিয়াটি নিয়ে ব্যাপক বিচার বিশ্লেষণ করে এবং প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশগামী যাত্রীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার রুপরেখা তৈরি করে। তবে তার বিদেশে গমনের নির্ধারিত তারিখ চলে আসায় সে তার এ পরিকল্পনা ঘনিষ্ঠ বন্ধু সবুজকে অবগত করে।
র্যাবের সংবাদ সম্মেলন
তিনি বলেন, সবুজকে প্রতারণার একটি টিম তৈরি করে দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত টাকা সমানভাগে বন্টনের প্রতিশ্রুতিতে সে বিদেশ গমন করে। সবুজ প্রতারণার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। তবে বেলালকে যে অর্থ প্রেরণ করা হতো তা নিয়ে বেলালের সবসময় সংশয় থেকে যায়। এই সংশয় থেকেই মূলত বেলাল ৪ মাস বিদেশে অবস্থান করে ২০২১ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে দেশে চলে আসে। এবার সে তার আরেকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু জসিমকে এই প্রতারণার কাজে সম্পৃক্ত করে। যেহেতু প্রতারণার এই প্রক্রিয়াটি খুবুই ঝুঁকিপূর্ণ তাই সে তার মধ্যপ্রাচ্যের ভিসা সচল রাখার জন্য পুনরায় ডিসেম্বর মাসে বিদেশ গমন করে এবং জানুয়ারি মাসে প্রতারণার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য পুনরায় দেশে চলে আসে। বেলাল, সবুজ ও জসিম ৪-৫ বছর আগে চট্টগ্রামে একইসাথে ভ্রাম্যমাণ কসমেটিক্সের ব্যবসা করত। সেই সূত্র ধরেই তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তাকৃত আবুল হোসেন নারায়ণগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়, আব্দুর নূর নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলায়, আহাম্মেদ হোসেন চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ জেলায়, আব্দুর রশিদ রাজধানী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলায়, আব্দুল করিম কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলায়, আলমগীর সিলেট, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলায়, আঙ্গুর মিয়া কুমিল্লা, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলায় সরকার নির্ধারিত বিদেশগামীদের করোনা টেস্ট হাসপাতালগুলোতে সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিদেশগামী যাত্রী ছদ্মবেশে অবস্থান করে এবং অত্যন্ত কৌশলে অন্যান্য সাধারণ যাত্রীদের নম্বরগুলো সংগ্রহ করে। নম্বরগুলো সংগ্রহ করে বেলাল ও সবুজকে প্রেরণ করত।
বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের প্রকৃত করোনা টেস্টের ফলাফল হাতে পাওয়ার আগেই বেলাল ও সবুজ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের করোনা বিভাগের ডাক্তার/হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরিচয় দিয়ে ভুক্তভোগীদের নম্বরে কল দিয়ে করোনা টেস্টের ফলাফল পজিটিভ আসছে বলে মিথ্যা তথ্য দিত। পরে পজিটিভ রেজাল্ট নেগেটিভ করে দেওয়ার কথা বলে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে জন প্রতি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঁচ থেকে বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিত। আলফাজ, জসিম, শামিম ও সুলতান একই সময়ে বেলাল ও সবুজকে বিভিন্ন জায়গার মোবাইল ব্যাংকিং এর নম্বর প্রদান করতো এবং ভুক্তভোগীরা বেলাল ও সবুজের কথা অনুযায়ী ওই সমস্ত নম্বরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা প্রেরণ করলে আলফাজ, জসিম, শামিম ও সুলতান স-শরীরে উপস্থিত থেকে তা সংগ্রহ করতো। ভুক্তভোগীর অবস্থান ও টাকা সংগ্রহের অবস্থান সব সময় ভিন্ন ভিন্ন জেলায় নির্ধারণ করা হতো, যাতে কেউ কোনো কিছু আঁচ করতে না পারে।
র্যাব জানায়, করোনাকালীন বিভিন্ন প্রতারক চক্র প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। তারা সাধারণ করোনার ভুয়া রিপোর্ট ও এসএমএস দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হাসপাতালে নির্দিষ্ট ফি প্রদানের মাধ্যমে বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা টেস্ট করানোর আদেশ জারি করা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশগামী যাত্রীরা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হাসপাতালে নির্দিষ্ট ফি দেওয়ার মাধ্যমে করোনা টেস্ট করে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিদেশগামী ব্যক্তিদের টার্গেট করে করোনা টেস্টের ভুয়া পজিটিভ রিপোর্টের কথা বলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে আসছে কয়েকটি চক্র। এরপরই অভিযান পরিচালনা করা হয়।