[ম্যাক নিউজ ডেস্ক]
নারীর প্রতি নির্যাতন, সহিংসতা ও ধর্ষণ ঠেকাতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন করেছে সরকার। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সভা-সিম্পোজিয়ামসহ নানাবিধ আয়োজন, কর্মসূচি আয়োজিত হচ্ছে। তবুও থামছে না নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতা। অপরাধীর দ্রুত বিচার নিশ্চিত করলে এসব অপরাধ কমবে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা।
তারা বলছেন, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানসিকতা থেকেই ক্ষমতা প্রয়োগের একটা কুৎসিত রূপ নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ। এর পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোরও একটা বিরাট প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন তারা। ফলে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব বা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে নারীদের যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার বানাচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ। এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই আসছে সংবাদমাধ্যমে। এভাবে ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে নারী।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবেঁধে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০১৮ সালে ৭৩২ জন, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন ও ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭ জন, ২০২১ সালে ১ হাজার ৩২১ জন এবং ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৫৪৬ জন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের প্রকাশিত তথ্যমতে, ২০১৯ সালে দেশে এক হাজার ৩৭০ জন, ২০২০ সালে এক হাজার ৩৪৬ জন, ২০২১ সালে এক হাজার ২৩৫ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় প্রতি বছরই গড়ে ১ হাজার ২৬০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার প্রায় অর্ধেকই ধর্ষণের।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্যানুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ১১ হাজার ৯৫৯টি ফোনকল এসেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ৬১৯টি, ধর্ষণচেষ্টা ৩১৪টি, যৌন নির্যাতন ২৬৮টি, ধর্ষণের হুমকি ৩১টি এবং উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানির ১ হাজার ৯টি।
একই অভিযোগে গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ১২ হাজার ১৬৯টি, ২০২০ সালে ৬ হাজার ৩৩১টি, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ১১৫টি এবং ২০১৮ সালে ২ হাজার ২৯২টি ফোনকল আসে।
মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা হিউম্যান রাইটস ভয়েস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সভাপতি আব্দুল আওয়াল নয়ন খান বলেন, দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ফলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন করা হলেও নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ কমছে না। এজন্য অপরাধীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান না দেখে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
ইয়াসমিনরা নির্যাতিত হচ্ছেই
১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট দীর্ঘদিন পর মাকে দেখতে ঢাকা থেকে দিনাজপুরে যাচ্ছিল কিশোরী ইয়াসমিন (১৩)। কিন্তু দিনাজপুরের কোচে না উঠতে পেরে পঞ্চগড়গামী একটি কোচে উঠে পড়ায় তাকে দিনাজপুরের দশমাইল নামক এলাকায় নামিয়ে দেওয়া হয়। এরপর পথে কিশোরী ইয়াসমিনকে ধর্ষণের পর হত্যা করে শহরতলির রাস্তার পাশে ফেলে যায় টহল পুলিশ।
ঘটনার দুদিন পর জনতা রাস্তায় নেমে এলে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে ৭ জন নিহত এবং আহত হন তিন শতাধিক মানুষ। ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায় হয় ১৯৯৭ সালের আগস্ট মাসে। রায়ে তিনজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়, রায় কার্যকর হয় ২০০৪ সালে।
অপর একটি ঘটনার তথ্যানুসন্ধান করে দেখা যায়, সিলেটে জুলি নামের এক নারীর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পরিচয় হয় ঢাকার উত্তরার আজমপুর এলাকার এক তরুণীর। ফেসবুকে তাদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। জুলির আমন্ত্রণে গত ২০ আগস্ট ঢাকা থেকে সিলেটে ঘুরতে যান ওই তরুণী। ওঠেন জুলির বাসায়। সন্ধ্যায় মেয়েটিকে জুলি তার স্বামী জুবায়ের হোসেনের হাতে তুলে দেন। এরপর টানা দুই দিন ওই ভাড়া বাসায় আটকে রেখে সাতজন তাকে ধর্ষণ করে।
গত ১২ আগস্ট জামালপুরের সরিষাবাড়িতে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় স্থানীয় এক স্কুলছাত্রীর ঘরে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করেন কনক হাসান নামের এক ব্যক্তি।
এ ঘটনার মাত্র ছয় দিন আগে গত ৬ আগস্ট গাজীপুরের শ্রীপুরে তাকওয়া পরিবহনের মিনিবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক গৃহবধূ। এর আগে তার স্বামীকে বাস থেকে ফেলে দেয় ধর্ষকরা।
গত পাঁচ বছর ধরে নারী নির্যাতনের ঘটনা ও ধর্ষণের মামলার হার বেড়েছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, বিচার প্রক্রিয়ার দুর্বলতা, দীর্ঘসূত্রতা এবং দোষীদের বিচার না হওয়ার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
সমাজে নারী-শিশু নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. সানজীদা আখতার বলেন, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানসিকতা থেকেই ক্ষমতা প্রয়োগের একটা কুৎসিত রূপ নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ। পর্যায়ক্রমে ওই জায়গাগুলোতে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে নারী নির্যাতন, সহিংসতা বা ধর্ষণের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোরও একটা বিরাট প্রভাব।