[ম্যাক নিউজ রিপোর্টেঃ- মাহফুজ বাবু কুমিল্লা]
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)’র আন্তরিকতায় সর্ষেক্ষেতে জন্ম নেয়া পরিচয়হীন এক নবজাতক পেল পিতা মাতা আর নিঃসন্তান দম্পত্তি পেলো তাদের সন্তান।
ঘটনার শুরু গত ১৬ জানুয়ারী সোমবার দুপুরে, ভবঘুরে মানসিক ভারসাম্যহীন বিবস্ত্র এক নারী প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে সদর দক্ষিণ উপজেলার গলিয়ারা উত্তর ইউনিয়ন পরিষদ ও ভূমি অফিস সংলগ্ন জনৈক ব্যক্তির সর্ষে ক্ষেতের পাশে শুয়ে পড়েন। এর আগে কখনোই তাকে এলাকায় কেউ দেখেনি বলেই জানায় স্থানীয়রা। স্থানীয় কয়েকজন বিষয়টি বুঝতে পেরে, আশেপাশের কয়েকজন নারী কে ডেকে আনেন। পরে সরিষা’র সেই জমিতেই স্বাভাবিক প্রসবে অভিজ্ঞ স্থানীয় নারীর সহায়তায় পৃথিবীর আলো দেখে ফুটফুটে এক নবজাতক। সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পরও মানুষিক ভারসম্যহীন মায়ের পেট ফুলে থাকায় পেটে টিউমার বা আরো সন্তান রয়েছে সন্দেহ হওয়ায় স্থানীয়রা তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষে গাফেলতির কারনে সেদিনই হাসপাতাল থেকে অজানা কোন গন্তব্যে হারিয়ে যায় মানুষিক ভারসাম্যহীন ঐ মা।
এদিকে সদ্য ভূমিষ্ট নবজাতকের দায়িত্ব নিতে গলিয়ারা এলাকায় শুরু হয় লড়াই। যার জমিতে শিশুটি ভূমিষ্ট হয় তিনি দাবী করেন নবজাতকের প্রকৃত হকদার তিনি, কেননা সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে তার জমিতে। অপর দিকে স্থানীয়দের একজন যিনি প্রসবের সময় সরঞ্জাম সহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ও চিকিৎসা সহায়তা করেন, তিনিও দাবি করেন নবজাতকে। প্রসবে সহায়তাকারী নারীদের অনেকেই দাবি তোলেন নবজাতকে নিজের করে পেতে। শুরু হয় দ্বন্দ্বের। এক পর্যায়ে নবজাতকে নিতে শুরু হয় দরকষাকষির। ৫০ হাজার থেকে শুরু করে দেড় লাখ টাকা দিয়েও নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন অনেকে। এখবর ছড়িয়ে পরে এক কান দু’কান করে গোটা উপজেলায়। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও ভুমি অফিস সূত্রে বিষয়টি জানতে পারেন সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাশিষ ঘোষ।
তাৎক্ষণিক ভাবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) কে অবহিত করে নবজাতক ও তার মায়ের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য বলেন। মিটিং শেষ করে মেডিকেল টিম, এম্বুলেন্স ও উপজেলা শিশু কল্যাণ বোর্ডের সদস্যদের নিয়ে হাজির হন ঘটনাস্থল ও নবজাতকের কাছে। বেওয়ারিশ নবজাতকের দায়িত্ব নিতে ততক্ষণে হাজির হয়েছে আরো অনেকে। সকলের মাঝে এক নিঃসন্তান ব্যবসায়ী ও তার স্ত্রীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পোশাক বেডিং সহ নবজাতকের জন্য যা যা প্রয়োজন এখানে আসার আগেই সব সাথে করে নিয়েও আসেন। ডাক্তারের পরামর্শে হাসপাতালে নেয়ার উদ্দেশ্যে এম্বুলেন্সে নবজাতকে তোলার সময় ইউএনও ও ওসির সামনেই কান্না জুড়ে দেন সেই দম্পত্তি। তারা যে কোন মূল্য শিশুটির বাবা মায়ের দায়িত্ব নিতে চান। সেই দম্পত্তি কে এবিষয়ে বিধি নিষেধ ও নিয়মের কথা জানান। তবে সেই দম্পতিও নাছোড়। অবশেষে নবজাতকের সঙ্গে তারাদেরকে নিয়ে আসেন হাসপাতালে। সেখানে ইউএনও পরিচয়হীন কন্যা নবজাতকটির নামও রাখেন ❝জয়ীতা❞।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাশিস ঘোষ জানান, হাসপাতালে গত দুদিন ধরে নবজাতকের দেখাশোনা ও খাবার দাবার সহ সকল বিষয়ে পরম যত্নের সাথেই নিজ সন্তানের মত দায়িত্ব পালন করেন সেই ব্যবসায়ী দম্পত্তি। এদিকে আশেপাশের এলাকা সহ হাসপাতালে খোঁজ নিয়েও নবজাতকের মায়ের কোন সন্ধান মিলছিলো না। অতঃপর মানবিক বিবেচনায় শিশুটির প্রতি হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা, তাদের অনুনয় বিনয়, অভিভাবক সুলভ দায়িত্ব পালন ও প্রচন্ড আগ্রহ দেখে নিঃসন্তান দম্পত্তি কেই ❝জয়িতা❞র দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া শেষে, সকল নিয়ম কানুন, প্রতি ৩মাস পর পর ১৮বছর পর্যন্ত উপজেলায় হাজির হওয়ার মত নানা শর্ত মেনে স্টাম্প পেপারে স্বাক্ষর করে ‘জয়িতা’র দায়িত্ব নেয় তারা। অজ্ঞাত ভারসম্যহীন মা’এর পরিচয় বা ঠিকানা জানা যায়নি। তার স্পষ্ট বা ভালো কোন ছবিও সংগ্রহ করা যায়নি। অস্পষ্ট যে ছবি পাওয়া গেছে তা থানায় দেয়া হয়েছে
জয়িতা’র ভবিষ্যৎ চিন্তা করে দম্পতির পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ করেন তিনি ।
এদিকে পরিচয়হীন নবজাতকে নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাশিস ঘোষের এমন মানবিক ও দায়িত্বশীল কর্মকাণ্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে, অনেকেই প্রশংসা করছেন তার।