[ম্যাক নিউজ রিপোর্ট:- কুমিল্লা প্রতিনিধি]
শৈশবে অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে অন্ধ হওয়া ইকবাল দমে যাননি জীবনযুদ্ধে। অন্ধত্বকে জয় করে অন্যের মুখে শুনে শুনে হয়েছেন কোরআনে হাফেজ। হাফেজ হওয়ার পর কোথাও চাকরি না পেয়ে বেছে নেননি ভিক্ষাবৃত্তি। বরং সংসারের হাল ধরতে অন্ধত্বের শত প্রতিকূলতা নিয়েও বাড়ির পাশে চায়ের দোকান দিয়ে করছেন ব্যবসা। চা দোকানের আয় দিয়েই কোনোমতে চলছে তার জোড়াতালির সংসার।
অন্ধ হাফেজ ইকবাল হোসেন (৩৫) কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশীদল ইউনিয়নের দক্ষিণ নাগাইশ এলাকার মৃত আছমত আলীর ছেলে।
জানা গেছে, যখন তার বয়স ৪ থেকে সাড়ে ৪ বছর তখন সে এক অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়। সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় ওই রোগে সে প্রাণে বেঁচে গেলেও তার দুটি চোখ অন্ধ হয়ে যায়। পড়াশোনার বয়সের আগেই অন্ধত্বের কারণে তার জীবনে নেমে আসে স্থায়ী অন্ধকার। তবুও সে হেরে যায়নি এই অন্ধত্বের কাছে। শত প্রতিকূলতা নিয়ে তারপর থেকে নতুন করে শুরু হয় তার জীবনযাপনের কষ্টময় পথচলা। অদম্য ইচ্ছে আর তার মায়ের অনুপ্রেরণায় অন্যের মুখে শুনে শুনে তিনি হয়েছেন কোরআনে হাফেজ। তারপর তিনি চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা করেন। কোনো চাকরি না পাওয়ায় সংসারের হাল ধরতে প্রথমে বিভিন্ন বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার সামনে গিয়ে চকলেট বিক্রি শুরু করেন। এতে রোজগারের তেমন আশা না দেখে পরে বাড়ির পাশে একটি চায়ের দোকান দিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। এই চায়ের দোকানের আয় দিয়েই কোনোমতে চলছে তার জোড়াতালির সংসার।
এদিকে অন্ধ হয়েও তিনি স্বাভাবিক মানুষের মতো কারও সাহায্য ছাড়াই করছেন দৈনন্দিনের সব কাজ। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি যুক্ত আছেন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও। তিনি নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘মুরাদ বেতার যুব সংঘ’ নামের একটি সামাজিক সংগঠন। সংগঠনটির মাধ্যমে এলাকার কৃতি শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয় বৃত্তি। এ ছাড়াও একসময় তিনি রচনা করতেন ইসলামিক গান। যা গাওয়া হতো বিভিন্ন বেতারে। ওই গানগুলো তিনি মুখে বলতেন অন্য একজন তা খাতায় লিখে দিতেন। সময়ের পরিক্রমায় আজ তা না থাকলেও সেই মনটা তার এখনো আছে। অবসরে গুন গুন করে গান করেন ও কোরআন পাঠ করেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, অন্ধ হয়েও তিনি তার জীবনযুদ্ধে হেরে যাননি। দৈনন্দিন সব কাজকর্ম করছেন কারও সহযোগিতা ছাড়াই। ছোট পরিসরে চালাচ্ছেন চায়ের দোকান। দোকানে চা বানানো, দৃষ্টিশক্তি ছাড়াই টাকা-পয়সা ঠিকঠাক মতো গুনে নেওয়া ও ফেরত দেওয়ার কাজটি করছেন কারও সাহায্য ছাড়াই। খরিদদারদের চাহিদা অনুযায়ী মালামালও দিচ্ছেন ঠিকঠাক মতো। তার দোকানের চায়ের কদর থাকায় দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন তার দোকানের চা খাওয়ার জন্য অনেকেই। স্বাভাবিক মানুষের মতোই দৈনন্দিন কাজকর্ম করছেন ঠিকঠাক মতো যা রীতিমতো অবাক হওয়ার মতো। তিনি এক ছেলে ও দুই কন্যাসন্তানের জনক। ছেলেকেও বানিয়েছেন কোরআনে হাফেজ। তার ছেলের নাম হাফেজ ইয়াসিন আরাফাত। ছেলের ছোট তাইফা আক্তার আফরিন ও সিরাজুম মনিরা নামে তার দুটো মেয়ে আছে। এরা সবাই এখনো নাবালক।
স্থানীয় লোকজন জানান, অন্ধ ইকবাল হাফেজ হওয়ার পর কিছুদিন স্থানীয় মসজিদে করেছিলেন ইমামতির চাকরি, তবে তাতেও আপত্তি আসে স্থানীয় সমাজপতিদের। অন্ধলোক ইমামতি করলে নামাজ হবে না এমন উদ্ভট যুক্তি দিয়ে তাকে বাদ দেওয়া হয় ইমামতি থেকে। ইমামতির চাকরি হারিয়ে মাত্র তিনশ টাকা পুঁজি নিয়ে প্রথমে চকলেট বিক্রি শুরু করেন তিনি। এতে আশার মুখ না দেখে পরে বাড়ির পাশে একটি চায়ের দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এ ব্যবসা পরিচালনায় তাকে সহযোগিতা করেন বিভিন্ন কোম্পানির লোকজন। বিভিন্ন কোম্পানির লোকজন বাকিতে পণ্য দিয়ে যান তাকে। এভাবেই অন্ধত্বকে জয় করে জীবনযুদ্ধে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেঁচে আছেন অন্ধ হাফেজ ইকবাল হোসেন ।
অন্ধ হাফেজ ইকবাল হোসেন জানান, শৈশবে অজ্ঞাত অসুখে অন্ধ হওয়ার পর থেকে নানা প্রতিকূলতা নিয়ে তিনি জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। মাথা গোঁজার যে ঘরটিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে তিনি বসবাস করেন তাতেও বৃষ্টি এলে পানি পড়ে। তিনি সমাজের হৃদয়বান লোকদের প্রতি আবেদন রাখেন, যদি কেউ স্বেচ্ছায় তাকে একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেন তাহলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তিনি শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান রিয়াদ কালবেলাকে বলেন, অন্ধ হাফেজ ইকবাল হোসেন একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তি। সে তার অন্ধত্বের সাথে যুদ্ধ করে অন্যের মুখে শুনে শুনে ত্রিশ পাড়া কোরআন মুখস্ত করেছে। প্রথমেই তাকে ধন্যবাদ দিই, কারণ তার জায়গায় থেকে সে সর্বোচ্চটা করেছে। পাশাপাশি সে পারিবারিক দারিদ্র্য দূর করার উদ্দেশ্যে বাড়ির কাছেই একটি মুদি দোকান দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে সাহায্য করেছি। পরিবার-পরিজন নিয়ে যে ঘরটিতে সে বসবাস করে সে ঘরটিও জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। আমি এটা নিয়েও কাজ করছি। আশা করছি, সম্মিলিতভাবে ও সরকারি অনুদান নিয়ে তাকে একটি ঘর করে দেব, যাতে সে পরিবারের লোকজন নিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে পারে।