[ ম্যাক নিউজ ডেস্ক ]
শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর অবৈধ সম্পদসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অনুসন্ধানে বিভিন্ন পদে ৪৭ জনকে নিয়োগের যাবতীয় নথিপত্র তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
একই সঙ্গে ২০১৯-২০ অর্থ বছরের প্রতিষ্ঠানটির আয়-ব্যয়ের যাবতীয় নথি পুনরায় তলব করেছে অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম। রোববার (৩ এপ্রিল) দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র চিঠি পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো চিঠিতে ২০১৭ সালে তিনটি সার্কুলারের মাধ্যমে যে ৪৭ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল সেই পরীক্ষার গ্রহণের নীতিমালা, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বরপত্রসহ নথি এবং ফল প্রকাশের ডেবুলেশনশিটের সত্যায়িত কপি চাওয়া হয়েছে। এসব নথিপত্র জরুরি ভিত্তিতে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণের জন্য অনুরোধ করেছে অনুসন্ধান টিম।
নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়ে দুদকে আসা অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে তিনটি সার্কুলারের মাধ্যমে ৪৭ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। শিল্পকলা একাডেমির বিভিন্ন পদে লিখিত পরীক্ষায় পাস না করেও বর্তমানে চাকরিতে বহাল আছেন ৪৬ জন। বলা হয়, নিয়োগের জন্য বিভিন্ন পদে পরীক্ষা হলেও সব শেষে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে পূর্বনির্ধারিত প্রার্থীদেরই। সে সময় লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধীনে। আর মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষা নেওয়া হয় শিল্পকলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে। লিখিত পরীক্ষায় যারা ফেল করেছেন তাদেরও মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয়েছিল। আর যারা পাস করেছেন তাদের অনেককে ডাকা হয়নি। ফেল করা যে প্রার্থীদের চাকরি দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে লাকীর লোকনাট্য দলের আটজন।
সূত্র আরও জানায়, নৃত্যশিল্পী ১২, সংগীত শিল্পী ৮, কালচারাল অফিসার ৬, শিল্পী ১০, ইন্সট্রাক্টর (নৃ) পদে ৩ জনকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। যাদের অধিকাংশই লিখিত পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেননি। যন্ত্রশিল্পী পদে ২০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছেন পাঁচজন, নিয়োগ পেয়েছেন ১০ জন। নৃত্যশিল্পী পদে পাস করেছেন চারজন, নিয়োগ পেয়েছেন ১২ জন। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে ওইসব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগে বলা হয়।
এছাড়া অপর এক চিঠিতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের আয় ও ব্যয়সংক্রান্ত বিভিন্ন ভাউচার-ক্যাশ বই এবং শিল্পকলা একাডেমি নামীয় সোনালী ব্যাংক হিসাবের বিবরণের কপি পুনরায় চাওয়া হয়েছে।
এর আগে গত ৫ জানুয়ারি সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় থেকে দেওয়া চিঠিতে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে শিল্পকলার ঢাকা কার্যালয়ে বরাদ্দকৃত বাজেট ও ব্যয়সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র সংবলিত নথির ফটোকপি এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে অব্যয়িত ৩৫ কোটি টাকা ২০২১ সালের ৩০ জুনে ব্যয়করণ-সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র তলব করা হয়েছিল। এছাড়াও ২০২০-২১ অর্থবছরে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান আয়োজন সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র সংবলিত নথির ফটোকপি, ২০১৯-২০২০ অর্থবছর থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত ব্যয়সংক্রান্ত বিভিন্ন ভাউচার-ক্যাশ বই এবং শিল্পকলা একাডেমি নামীয় সোনালী ব্যাংক (সেগুনবাগিচা শাখা) অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্টের কপি। এর মধ্যে আংশিক নথিপত্র সরবরাহ করা হয় বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
গত ১৬ জানুয়ারি লিয়াকত আলী লাকীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাংবাদিকদের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অধিকাংশই অপপ্রচার বলে দাবি করেন তিনি।
লাকী বলেন, যেসব বিলের কথা বলা হয়েছে, কোনোটিতেই আমার সই নেই। আপনারা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করবেন বলে আশা করি। আপনারা ২৬ কোটি টাকা উত্তোলনের কথা বলছেন, সেটা হবে ২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। ১৩ কোটি টাকা বেতন-বোনাস, পৌরকর ও বিদ্যুৎ বিলসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে দেড় কোটির মতো ভ্যাট-ট্যাক্সে জমা হয়েছে।
চলতি বছরের ২ জানুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে উপপরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়ার সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করা হয়। লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়া, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
প্রায় এক যুগ ধরে মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে অনিয়মের মাধ্যমে ২৬ কোটি টাকা তুলে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে চুক্তিভিত্তিক এক কর্মকর্তাকে সচিবের দায়িত্ব দিয়ে এ অর্থ উত্তোলন করে নেয় লিয়াকত আলী লাকীসহ একটি সিন্ডিকেট।
দুদকে দাখিল করা অভিযোগ সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০২১ সালের ৩০ জুন শিল্পকলা একাডেমির আগের সচিব নওশাদ হোসেন বদলি হলে সেদিনই নতুন আদেশ জারি করে একাডেমির চুক্তিভিত্তিক পরিচালক সৈয়দা মাহবুবা করিমকে সচিবের দায়িত্ব দেন লাকী। ৩০ জুন থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে প্রায় ২৬ কোটি টাকা বিভিন্ন কৌশলে উত্তোলন করা হয়। সরকারি বরাদ্দের অর্থ খরচ দেখাতেই এমন অনিয়ম দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে দুদকে দাখিল হওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে।
এছাড়া লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে একাধিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। সংগীত বিভাগের কক্ষে ব্যবহারের জন্য পর্দা, ক্রোকারিজ ও ফার্নিচার না কিনে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ বরাদ্দ, ডান্স অ্যাগেইনস্ট করোনা কর্মসূচির আওতায় নৃত্যদলের সম্মানী, হার্ডডিস্ক কেনা, ডকুমেন্টেশন, প্রপস-কস্টিউম, প্রচার ও বিবিধ ব্যয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের তোলার অভিযোগ উঠেছে।